ছেলেবেলায় যারা দাদু ঠাকুমার কাছে রূপকথার গল্প শুনে বড় হয়েছে তাদের মত ভাগ্যবান মনে হয় এই দুনিয়ায় আর কেউ নেই। কালের নিয়মে এখন অবশ্য সেই চল আর নেই।গল্প দাদুর আসর, ঠাকুমার ঝুলি, টিনটিন অ্যাস্টেরিক্সের জায়গা আজ দখল নিয়েছে মুখবই, হোয়াট্স্যাপের ধুসর দুনিয়া। আজ আমরা সেরকমই হারিয়ে যাওয়া এক গল্প বলব, যা রূপকথার অলীক কল্পনা মনে হলেও কঠোর বাস্তব। আজ আমরা কথা বলব অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত ভাওয়াল প্রদেশের রাজা রমেন্দ্রনারায়ণকে নিয়ে। যাকে নিয়ে একসময় বাংলা তথা সারা ভারতবর্ষ তোলপাড় হয়ে ওঠে। এমনকি সেই তোলপাড়ের আঁচ গিয়ে পড়ে টেমস নদীর তীরেও। ভাওয়ালের সন্ন্যাসী রাজার এই কাহিনী না শুনলে তা অনুমান করাও অসম্ভব।
আমাদের গল্পের মুখ্য চরিত্র রাজা রমেন্দ্রনারায়ণ ছিলেন রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ ও রানী বিলাসমণির তিন পুত্র সন্তানের মধ্যে মধ্যমজন। রাজেন্দ্র নারায়ণ রাজ্য সামলানো দূরে থাক নিজেকেই ঠিক করে সামলাতে পারতেন না। তাই স্বাভাবিকভাবেই রাজ্যের রাশ ছিল রানী বিলাসমণির হাতে। নিজ সন্তানদের হাজার চেষ্টা করেও ঠিক মতো মানুষ করতে ব্যর্থ হন রানীমা। তিন পুত্র, বিশেষ করে মেজকুমার বেড়ে ওঠেন নিজ পিতার ধাঁচেই। ১৯০২ সালে রমেন্দ্রনারায়ণের বিয়ে হয় অপূর্ব সুন্দরী বিভাবতী দেবীর সাথে। মেজকুমারের উল্লেখযোগ্য কোনো গুণাবলী ছিলনা বললেই চলে, সারাদিন শিকার এবং নারীসঙ্গেই মজে থাকতেন তিনি। ওদিকে রানী বিভাবতী দেবী ধীরে ধীরে তাদের পারিবারিক ডাক্তার আশুতোষ দাসগুপ্তের সাথে অবৈধ সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। ঘটনাচক্রে রানী একসময় সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়েন যখন রোগভারাক্রান্ত মেজকুমার ছিলেন সন্তানলাভে অক্ষম। এই কথা জানাজানি হতেই রানী পড়েন আতান্তরে।
ইতিমধ্যে রাজার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে আশুতোষ ডাক্তার রাজাকে হাওয়া বদলের পরামর্শ দেন। অতঃপর ১৯০৯ সালে এপ্রিলের মাঝামাঝি দার্জিলিং - এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন মেজকুমার, সঙ্গী হলেন রানী, রানীর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ, ডাক্তার আশুতোষ এবং ব্যাক্তিগত কর্মচারী মিলিয়ে ২৭জন।
দার্জিলিং যাওয়ার দিন পনেরো আগে একটি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার শিকার করার পর বাঘটির সাথে ছবি তোলেন মেজকুমার। " টাইগার ফটো" নামে পরিচিত এই ছবিটি রাজা হিসাবে মেজকুমারের শেষ ছবি যা উনবিংশ শতাব্দীর একটি অন্যতম ছবি হিসাবে বাংলাদেশ আর্কাইভ প্রদর্শনীতে স্থান পায়।
হাওয়া বদলে যাওয়ার পর থেকে রাজার শারীরিক অবস্থার ক্রমশ অবনতি হতে থাকে, কারন রানী, রানীর ভাই এবং ডাক্তার আশুতোষ- তিনজন মিলে চক্রান্ত করে ক্রমাগত বিষ প্রয়োগ করতে থাকেন মেজকুমারকে। অবশেষে ৮ই মে সন্ধ্যা ৭ টা থেকে ৮টার মধ্যে রাজার মৃত্যু হয়েছে বলে মনে করা হয়। দার্জিলিং এর শ্মশানে তড়িঘড়ি শেষকৃত্য সম্পন্ন করে ১০ই মে মেজরানী ও বাকিরা ফিরে আসেন। ১৮ই মে মেজকুমারের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান পালন করা হয়।
আর পাঁচটা কাহিনীর মত এটাও এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু ইতিহাস কখনই অন্যায়কে লালন করেনা। পৃথিবীর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কেউ রেহাই পায়নি ইতিহাসের নির্মমতার হাত থেকে।
[ আরও পড়ুন ঃ আন্দামানের ইতিকথা ]
[ আরও পড়ুন ঃ প্রত্যাখ্যাত শাহেনশাহ্]
[ আরও পড়ুন ঃ একটু দেরী, পন্ডিচেরী।]
[ আরও পড়ুন ঃ জানা অজানা রবীন্দ্রনাথ। ]
এই ঘটনার ঠিক ১২ বছর পর, ১৯২১ সালের মে মাসে ঢাকায় হঠাৎ আত্মপ্রকাশ ঘটে এক সন্ন্যাসীর, দেখতে অবিকল মেজকুমারের মত। খবর পাঁচকান হতে বেশি সময় লাগলো না, দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল জয়দেবপুর এবং কাশিমপুরের জমিদার বাড়িতে। খবর পেয়ে সন্ন্যাসীর সাথে দেখা করেন মেজকুমারের বোন জ্যোতির্ময়ী দেবী। প্রথম দর্শনেই জ্যোতির্ময়ী দেবীর চোখ আটকে যায়। তিনি লক্ষ্য করেন যে তাঁর ভাইয়ের মত সন্ন্যাসীরও খাওয়ার সময় ডান হাতের তর্জনী আলগা হয়ে যায় এবং জিহ্বা বেরিয়ে আসে। পরিচয় প্রমানের সমস্ত পরীক্ষায় সন্ন্যাসী সহজেই উতরে যান। রাজবাড়ির খুঁটিনাটি, সদস্যদের সম্পর্কিত নানা ঘটনা, আস্তাবলে কটা ঘোড়া ছিল, হাতিশালে কটা হাতি ছিল, কতজন চাকর কর্মচারী ছিল সব গড়গড় করে বলে যেতে থাকেন।
পরীক্ষায় যত সহজেই পাস করে যান না কেন, রানী বিভাবতী দেবী এবং তাঁর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ এর পক্ষে সন্ন্যাসীকে মেজকুমার হিসাবে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। কারন ততদিনে ক্ষমতায় আসীন রানী বিয়ে করেছেন ডাক্তার আশুতোষকে এবং রাজার বিমা ও জমিদারী থেকে প্রাপ্ত লক্ষ্যাধিক টাকা আত্মসাৎ করেছেন রানীর ভাই। প্রায় এক যুগ পর মৃত রাজা দৃশ্যপটে হাজির হতে শুরু হল রাজত্ব দখল করে বসা সুবিধাভোগীদের জটিল চক্রান্ত। সন্ন্যাসীকে প্রতারক প্রমান করতে কোমর বেঁধে লেগে পড়েন তারা। রাজপরিবার শুধু নয়, রাষ্ট্রযন্ত্র এমনকি সাধারন প্রজামহলও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন।
সন্ন্যাসীর মুখ থেকেই জানা যায় আশুতোষ ডাক্তারের দেওয়া বিষের ক্রিয়ায় ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়া মেজকুমার হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়লে তৎক্ষণাৎ তাঁরা রাজাকে মৃত ঘোষণা করে সৎকার করার ব্যবস্থা করেন। পথে প্রবল ঝড় বৃষ্টি এলে, রাজাকে পথেই ফেলে রেখে বাকিরা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। সেই সময় সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন কিছু নাগা সন্ন্যাসী। তাঁরা এইভাবে একজনকে অচেতন অবস্থায় রাস্তার মাঝে পড়ে থাকতে দেখে তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। রানীর লোকেরা ঝড় শেষে ফিরে এসে দেখেন যে রাজা সেখানে নেই। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অগত্যা তাঁরা ফিরে আসেন। ওদিকে নাগা সন্ন্যাসীদের সেবায় রাজা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন, কিন্তু সাময়িকভাবে তাঁর স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষিত রাজা এরপর নানা জায়গা ঘুরে বেড়ানোর পর বাংলাদেশে এসে তাঁর স্মৃতি ফিরে পান। এরপর তিনি নিজের রাজত্বে প্রত্যাবর্তন করেন সত্যকে সবার সামনে নিয়ে আসার জন্য।
সত্য উদ্ঘাটনের দায়িত্ব ন্যস্ত হয় আদালতের ওপর। দীর্ঘ প্রায় ছয় বছর বাদী বিবাদী উভয় উভয়পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহন চলে। সমস্ত সাক্ষ্য প্রমান বিচার করার পর বিচারক পান্নালাল বসু ১৯৩৬ সালের ২৪শে আগস্ট সন্ন্যাসী রাজার পক্ষে ৫৩২ পাতার রায় দেন। উভয়পক্ষের হয়ে সাক্ষ্য দেন ১৫৪৮ জন। তৎকালীন বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রে দীর্ঘতম নজিরবিহীন এই মামলা দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, যে মামলা "ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা" নামে পৃথিবী বিখ্যাত।
বিবাদিপক্ষ্য এই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করেন। ১৯৪০ সালের ২৯শে আগস্ট বিচারপতি আগের রায়ই বহাল রাখেন। এরপর আপিল করেন লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে। ১৯৪৬ সালের ৩০শে জুলাই প্রিভি কাউন্সিলও সন্ন্যাসী রাজার পক্ষেই রায় দেন। এর ঠিক তিনদিন পরেই রাজা মারা যান, যেন সত্য প্রতিষ্ঠার অপেক্ষাতেই ছিলেন তিনি।
ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা এতই প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল যে, ভারতবর্ষের বিখ্যাত মামলাগুলির মধ্যে এটি দিল্লিতে গত শতাব্দীর আলোড়ন সৃষ্টিকারী অন্যতম শ্রেষ্ঠ মামলা হিসাবে স্থান পেয়েছিল। এই মামলা নিয়ে প্রচুর লেখালিখি হয় দেশে বিদেশে, অজস্র নাটক যাত্রা পালা রচিত হয় এই কাহিনী নিয়ে। উত্তম কুমার অভিনীত 'সন্ন্যাসী রাজা' সিনেমাটি এই কাহিনী থেকেই অনুপ্রানিত।
৩৬০ কক্ষ্যবিশিষ্ট সেই ভাওয়াল রাজবাড়ি আজ গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু এর ঠিক উল্টোদিকে থাকা আশু ডাক্তারের বাড়িটি রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে ধুলিস্মাত হয়ে যেতে বসেছে।
প্রতিবেদনটি আপনাদের কেমন লাগলো নিচে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না। ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে অবশ্যই শেয়ার করুন। পরবর্তী পোষ্টের নোটিফিকেশান পেতে ব্লগটি ফলো অপশনে ক্লিক করুন।
[ আরও পড়ুন ঃ'লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন'- কে এই গৌরী সেন?]
[ আরও পড়ুন ঃ'দাদা সাহেব ফালকে' পুরস্কার পেয়েও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সুচিত্রা সেন। কেন জানেন? ]
[আরও পড়ুন ঃ ট্রেন-এ শৌচালয় অন্তর্ভুক্তির পিছনে অবদান কার জানেন? ]
[আরও পড়ুন ঃ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের আগে এখানে ছিল একটি জেলখানা। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল সম্পর্কে অজানা কিছু তথ্য। ]
আমাদের গল্পের মুখ্য চরিত্র রাজা রমেন্দ্রনারায়ণ ছিলেন রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ ও রানী বিলাসমণির তিন পুত্র সন্তানের মধ্যে মধ্যমজন। রাজেন্দ্র নারায়ণ রাজ্য সামলানো দূরে থাক নিজেকেই ঠিক করে সামলাতে পারতেন না। তাই স্বাভাবিকভাবেই রাজ্যের রাশ ছিল রানী বিলাসমণির হাতে। নিজ সন্তানদের হাজার চেষ্টা করেও ঠিক মতো মানুষ করতে ব্যর্থ হন রানীমা। তিন পুত্র, বিশেষ করে মেজকুমার বেড়ে ওঠেন নিজ পিতার ধাঁচেই। ১৯০২ সালে রমেন্দ্রনারায়ণের বিয়ে হয় অপূর্ব সুন্দরী বিভাবতী দেবীর সাথে। মেজকুমারের উল্লেখযোগ্য কোনো গুণাবলী ছিলনা বললেই চলে, সারাদিন শিকার এবং নারীসঙ্গেই মজে থাকতেন তিনি। ওদিকে রানী বিভাবতী দেবী ধীরে ধীরে তাদের পারিবারিক ডাক্তার আশুতোষ দাসগুপ্তের সাথে অবৈধ সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। ঘটনাচক্রে রানী একসময় সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়েন যখন রোগভারাক্রান্ত মেজকুমার ছিলেন সন্তানলাভে অক্ষম। এই কথা জানাজানি হতেই রানী পড়েন আতান্তরে।
ইতিমধ্যে রাজার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে আশুতোষ ডাক্তার রাজাকে হাওয়া বদলের পরামর্শ দেন। অতঃপর ১৯০৯ সালে এপ্রিলের মাঝামাঝি দার্জিলিং - এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন মেজকুমার, সঙ্গী হলেন রানী, রানীর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ, ডাক্তার আশুতোষ এবং ব্যাক্তিগত কর্মচারী মিলিয়ে ২৭জন।
দার্জিলিং যাওয়ার দিন পনেরো আগে একটি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার শিকার করার পর বাঘটির সাথে ছবি তোলেন মেজকুমার। " টাইগার ফটো" নামে পরিচিত এই ছবিটি রাজা হিসাবে মেজকুমারের শেষ ছবি যা উনবিংশ শতাব্দীর একটি অন্যতম ছবি হিসাবে বাংলাদেশ আর্কাইভ প্রদর্শনীতে স্থান পায়।
টাইগার ফটো |
হাওয়া বদলে যাওয়ার পর থেকে রাজার শারীরিক অবস্থার ক্রমশ অবনতি হতে থাকে, কারন রানী, রানীর ভাই এবং ডাক্তার আশুতোষ- তিনজন মিলে চক্রান্ত করে ক্রমাগত বিষ প্রয়োগ করতে থাকেন মেজকুমারকে। অবশেষে ৮ই মে সন্ধ্যা ৭ টা থেকে ৮টার মধ্যে রাজার মৃত্যু হয়েছে বলে মনে করা হয়। দার্জিলিং এর শ্মশানে তড়িঘড়ি শেষকৃত্য সম্পন্ন করে ১০ই মে মেজরানী ও বাকিরা ফিরে আসেন। ১৮ই মে মেজকুমারের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান পালন করা হয়।
আর পাঁচটা কাহিনীর মত এটাও এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু ইতিহাস কখনই অন্যায়কে লালন করেনা। পৃথিবীর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কেউ রেহাই পায়নি ইতিহাসের নির্মমতার হাত থেকে।
[ আরও পড়ুন ঃ আন্দামানের ইতিকথা ]
[ আরও পড়ুন ঃ প্রত্যাখ্যাত শাহেনশাহ্]
[ আরও পড়ুন ঃ একটু দেরী, পন্ডিচেরী।]
[ আরও পড়ুন ঃ জানা অজানা রবীন্দ্রনাথ। ]
এই ঘটনার ঠিক ১২ বছর পর, ১৯২১ সালের মে মাসে ঢাকায় হঠাৎ আত্মপ্রকাশ ঘটে এক সন্ন্যাসীর, দেখতে অবিকল মেজকুমারের মত। খবর পাঁচকান হতে বেশি সময় লাগলো না, দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল জয়দেবপুর এবং কাশিমপুরের জমিদার বাড়িতে। খবর পেয়ে সন্ন্যাসীর সাথে দেখা করেন মেজকুমারের বোন জ্যোতির্ময়ী দেবী। প্রথম দর্শনেই জ্যোতির্ময়ী দেবীর চোখ আটকে যায়। তিনি লক্ষ্য করেন যে তাঁর ভাইয়ের মত সন্ন্যাসীরও খাওয়ার সময় ডান হাতের তর্জনী আলগা হয়ে যায় এবং জিহ্বা বেরিয়ে আসে। পরিচয় প্রমানের সমস্ত পরীক্ষায় সন্ন্যাসী সহজেই উতরে যান। রাজবাড়ির খুঁটিনাটি, সদস্যদের সম্পর্কিত নানা ঘটনা, আস্তাবলে কটা ঘোড়া ছিল, হাতিশালে কটা হাতি ছিল, কতজন চাকর কর্মচারী ছিল সব গড়গড় করে বলে যেতে থাকেন।
পরীক্ষায় যত সহজেই পাস করে যান না কেন, রানী বিভাবতী দেবী এবং তাঁর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ এর পক্ষে সন্ন্যাসীকে মেজকুমার হিসাবে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। কারন ততদিনে ক্ষমতায় আসীন রানী বিয়ে করেছেন ডাক্তার আশুতোষকে এবং রাজার বিমা ও জমিদারী থেকে প্রাপ্ত লক্ষ্যাধিক টাকা আত্মসাৎ করেছেন রানীর ভাই। প্রায় এক যুগ পর মৃত রাজা দৃশ্যপটে হাজির হতে শুরু হল রাজত্ব দখল করে বসা সুবিধাভোগীদের জটিল চক্রান্ত। সন্ন্যাসীকে প্রতারক প্রমান করতে কোমর বেঁধে লেগে পড়েন তারা। রাজপরিবার শুধু নয়, রাষ্ট্রযন্ত্র এমনকি সাধারন প্রজামহলও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন।
সন্ন্যাসীর মুখ থেকেই জানা যায় আশুতোষ ডাক্তারের দেওয়া বিষের ক্রিয়ায় ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়া মেজকুমার হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়লে তৎক্ষণাৎ তাঁরা রাজাকে মৃত ঘোষণা করে সৎকার করার ব্যবস্থা করেন। পথে প্রবল ঝড় বৃষ্টি এলে, রাজাকে পথেই ফেলে রেখে বাকিরা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। সেই সময় সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন কিছু নাগা সন্ন্যাসী। তাঁরা এইভাবে একজনকে অচেতন অবস্থায় রাস্তার মাঝে পড়ে থাকতে দেখে তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। রানীর লোকেরা ঝড় শেষে ফিরে এসে দেখেন যে রাজা সেখানে নেই। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অগত্যা তাঁরা ফিরে আসেন। ওদিকে নাগা সন্ন্যাসীদের সেবায় রাজা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন, কিন্তু সাময়িকভাবে তাঁর স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষিত রাজা এরপর নানা জায়গা ঘুরে বেড়ানোর পর বাংলাদেশে এসে তাঁর স্মৃতি ফিরে পান। এরপর তিনি নিজের রাজত্বে প্রত্যাবর্তন করেন সত্যকে সবার সামনে নিয়ে আসার জন্য।
প্রত্যাবর্তনের পর সন্ন্যাসী রাজা |
সত্য উদ্ঘাটনের দায়িত্ব ন্যস্ত হয় আদালতের ওপর। দীর্ঘ প্রায় ছয় বছর বাদী বিবাদী উভয় উভয়পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহন চলে। সমস্ত সাক্ষ্য প্রমান বিচার করার পর বিচারক পান্নালাল বসু ১৯৩৬ সালের ২৪শে আগস্ট সন্ন্যাসী রাজার পক্ষে ৫৩২ পাতার রায় দেন। উভয়পক্ষের হয়ে সাক্ষ্য দেন ১৫৪৮ জন। তৎকালীন বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রে দীর্ঘতম নজিরবিহীন এই মামলা দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, যে মামলা "ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা" নামে পৃথিবী বিখ্যাত।
বিবাদিপক্ষ্য এই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করেন। ১৯৪০ সালের ২৯শে আগস্ট বিচারপতি আগের রায়ই বহাল রাখেন। এরপর আপিল করেন লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে। ১৯৪৬ সালের ৩০শে জুলাই প্রিভি কাউন্সিলও সন্ন্যাসী রাজার পক্ষেই রায় দেন। এর ঠিক তিনদিন পরেই রাজা মারা যান, যেন সত্য প্রতিষ্ঠার অপেক্ষাতেই ছিলেন তিনি।
ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা এতই প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল যে, ভারতবর্ষের বিখ্যাত মামলাগুলির মধ্যে এটি দিল্লিতে গত শতাব্দীর আলোড়ন সৃষ্টিকারী অন্যতম শ্রেষ্ঠ মামলা হিসাবে স্থান পেয়েছিল। এই মামলা নিয়ে প্রচুর লেখালিখি হয় দেশে বিদেশে, অজস্র নাটক যাত্রা পালা রচিত হয় এই কাহিনী নিয়ে। উত্তম কুমার অভিনীত 'সন্ন্যাসী রাজা' সিনেমাটি এই কাহিনী থেকেই অনুপ্রানিত।
সন্ন্যাসী রাজা সিনেমায় উত্তম কুমার |
ভাওয়াল রাজবাড়ি |
[ আরও পড়ুন ঃ'লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন'- কে এই গৌরী সেন?]
[ আরও পড়ুন ঃ'দাদা সাহেব ফালকে' পুরস্কার পেয়েও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সুচিত্রা সেন। কেন জানেন? ]
[আরও পড়ুন ঃ ট্রেন-এ শৌচালয় অন্তর্ভুক্তির পিছনে অবদান কার জানেন? ]
[আরও পড়ুন ঃ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের আগে এখানে ছিল একটি জেলখানা। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল সম্পর্কে অজানা কিছু তথ্য। ]